‘উল্লাসকর’ শুধু এক অপার্থিব দামাল প্রেমিকের গায়ে কাঁটা দেওয়া কাহিনীও নয়। ‘উল্লাসকর’ শুধুমাত্র ‘কৃষ্ণসিন্ধুকী’ উপন্যাসের প্রিকোয়েল নয়।

অনলাইনে বইটি প্রিবুক করুন এখানেঃ https://boichitro.in/product/ullashkor-debarati-mukhopadhyay/
আমাজনেঃ https://www.amazon.in/dp/9349189674
‘উল্লাসকর’ এমন এক মানুষের গায়ে কাঁটা দেওয়া গল্প , যিনি একইসঙ্গে ছিলেন দুর্দমনীয় বিপ্লবী এবং অবিনশ্বর প্রেমিক। ১০০ ভাগ খাঁটি সোনার মত।
না। আন্দামানে সেলুলার জেলে শত অত্যাচারেও মাথা না নোয়ানো এই সাহসী বিপ্লবী সেভাবে আমাদের দেশের ইতিহাসে স্থান পাননি। স্থান পাওয়ার মত সমীকরণের যোগসাজশ তিনি কোনদিনও শেখেননি। তাঁকে এইসব মানায়ও না। তবু আজও প্রশ্ন জাগে, দেশ এমন নিঃস্বার্থ সন্তান আর একজনকেও পেয়েছে কি?

কিছু ইঙ্গিত ঈশ্বরপ্রেরিত আদেশ বলে মনে করি। ‘উল্লাসকর” ও তেমনই।
বছর আড়াই আগে আন্দামান সেলুলার জেলে নির্বাসন দেওয়া বিস্মৃত বন্দিনীদের নিয়ে যখন ‘কৃষ্ণসিন্ধুকী’ লিখতে শুরু করেছিলাম, তখনো ভাবিনি এমন কিছু ঘটতে পারে। উপন্যাসটি আলিপুর জেল মিউজিয়ামে প্রকাশিত হয়, এবং অত্যন্ত পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। কিন্তু ‘কৃষ্ণসিন্ধুকী’ লিখতে গিয়ে উপন্যাসের যে পার্শ্বচরিত্রটিকে আমি নবরূপে আবিষ্কার করি, তিনি ক্রমশ আমার পুরো লেখক সত্ত্বাকে অধিকার করতে থাকেন। আমার মনে হতে থাকে, পার্শ্ব চরিত্র নয়, তাঁর গোটা জীবনটা এতটাই নাটকীয়, এতটাই রুদ্ধশ্বাস, এতটাই মায়াবী, যে এই নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে কাজ করা আমার কর্তব্য মনে হতে থাকে।
উল্লাসকর দত্ত। ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া নায়ক, হারিয়ে যাওয়া প্রেমিক। বাঙালির রোমিও ও জুলিয়েটের বাস্তব উদাহরণ।
কুমিল্লা থেকে কলকাতা, আন্দামান থেকে আসামের শিলচর, বোম্বাই থেকে বাংলা, বিরাট পটভূমিতে এ এক রোমহর্ষক ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস।
আসছে ‘উল্লাসকর – বোমা বিপ্লব প্রেমের মহাকাব্য’।
কেমিস্ট্রির বিদ্যা কাজে লাগিয়ে যে হাতে বানাতেন বোমা, সেই হাতেই আদরে বুকে তুলে নিচ্ছেন প্যারালাইজড বাল্যপ্রেমিকাকে। তেষট্টি বছর বয়সে বিবাহ করছেন ষাটোর্ধ প্রৌঢ়াকে। হা হা করে হাসতেন, মাতিয়ে রাখতেন শত বিষাদেও, আবার দপ করে জ্বলে উঠতেন দাবানলের মত। পৃথিবী এমন প্রেমিক আর একটাও পেয়েছে কি?
কেউ তাঁকে মনে রেখেছেন দুর্ধর্ষ আলিপুর বোমা মামলার বিপ্লবী হিসেবে, কারুর কাছে তিনি প্রেসিডেন্সির চোখধাঁধানো সেই কেমিস্ট্রির ছাত্র, যিনি ভারতবিদ্বেষী প্রোফেসরকে জুতোপেটা করার জন্য কলেজ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। শুধু পড়াশুনোয় মেধাবী নন, যেমন গাইতে পারেন, তেমন সবাইকে মাতিয়ে রাখতে। নিজের ফাঁসির সাজা শুনে আলিপুর আদালতে যখন উদাত্তকন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে উঠেছিলেন, তখন ইংরেজ জাজের চোখও শুকনো থাকেনি।
কেউ আবার মনে রেখেছেন, কীভাবে আন্দামানের সেলুলার জেলে চরম অত্যাচারে তিনি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন! বছরের পর বছর বন্দি থেকেছেন মাদ্রাজের পাগলাগারদে। কিন্তু যার নামেই ‘উল্লাস’, তাঁকে কাবু করতে পারে, এমন কি কেউ থাকতে পারে? তিনি ছিলেন আমার ‘কৃষ্ণসিন্ধুকী’ উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র। সেলুলার জেলের সেই অত্যাচার সুবিস্তৃত লিখেছি এই উপন্যাসে।

তিনি উল্লাস! উল্লাসকর দত্ত। কারুর কাছে ডাকাবুকো দেশপ্রেমিক, কারুর কাছে গানকবিতাপ্রেমী, কারুর কাছে কিছুটা হঠকারী প্রাণশক্তিতে ভরপুর এক অদম্য মনোবলের মানুষ।
কিন্তু আমার কাছে? আমার কাছে তিনি সবার ওপরে এক উত্তাল প্রেমিক! যেমন প্রেমিকের স্বপ্ন প্রতিটি মেয়ে লালন করে। বিপিন পালের কন্যা লীলার সঙ্গে বহুবছরের প্রেম। প্রেমিকার জন্য কত কী ই যে করেছেন! শিবপুরের বাড়ি থেকে খেজুর রসের হাঁড়ি মাথায় করে নিয়ে টানা হেঁটে গেছেন লীলাদের সুকিয়া স্ট্রীটের বাড়িতে, টাটকা খেজুর গুড় খেতে মেয়েটা বড় ভালবাসে যে!
ফাঁসির আদেশ সেলুলার জেলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে যখন বদলে গেল, আন্দামানের জাহাজে ওঠার আগে তিনি লীলাকে জিজ্ঞেস করলেন, “অপেক্ষা করবে তো? যাবজ্জীবন থাকতে হবে না, দেখবে আমি ঠিক ছাড়া পাব। আমরা কিন্তু স্বাধীন ভারতবর্ষে বিয়ে করবই!”
এগ্রিকালচারের উঁচুক্লাসের ছাত্রী লীলা বলেছিলেন, “আমি অপেক্ষা করব।”
দিনের পর দিন কেটেছে। মাসের পর মাস। বছরের পর বছর। সেলুলার জেলে অমানুষিক অত্যাচারে, ইলেক্ট্রিক শকে, শত লাঞ্ছনা, অর্ধাহার, অনাহারেও নুয়ে যায়নি উল্লাসকরের মেরুদণ্ড। লীলার চিঠি এসেছে। তিনিও চিঠি লিখেছেন। স্বপ্ন দেখেছেন, কোন একদিন লীলা তাঁর হবে। হবেই। লীলাও লন্ডন গেছে। ফিরে এসে একাধিক চাকরি নিয়েছে। বয়স ত্রিশ পেরিয়েছে। সে বিয়ে করেনি।
কিন্তু এখানেও খলনায়ক ব্রিটিশ কূটনীতি। ইন্দুভূষণের জেলের মধ্যেই আত্মহত্যার পর রাতারাতি উল্লাসকরকে মাথা খারাপের দোহাই দিয়ে সকলের অগোচরে পাঠিয়ে দেওয়া হল মাদ্রাজের পাগলাগারদে।
কেউ জানল না সেই খবর। না উল্লাসকরের সহবন্দীরা, না বাড়ির লোক। সেলুলার জেলে চিঠি গেলে ফেরত চলে আসে। জেলারকে প্রশ্ন করে চিঠি লিখলে উত্তর আসে না। সবাই ভাবল, উল্লাস বোধহয় আর বেঁচে নেই। শত শত সেলুলার জেলের বিপ্লবীদের মত তাকেও মেরে ফেলা হয়েছে।
রিক্ত, ক্লান্ত লীলা ততদিনে অনাথ, একা। চল্লিশে পৌঁছে বিয়ে করে নিতে বাধ্য হচ্ছে বোম্বাইবাসী নৃপেন বসুকে।
সুস্থ হয়ে কলকাতা ফিরে রাগে জ্বলে উঠছেন উল্লাসকর। লীলার ভাই নিরঞ্জনের কাছ থেকে খবর পেয়ে নিজের কাছে সযত্নে গুছিয়ে রাখা সব চিঠিপত্র নিয়ে সোজা পাড়ি দিচ্ছেন বোম্বাইতে।
নৃপেন লীলার কান্দিভালির বাড়ির সামনে গিয়ে তীব্র হাঁকডাক, “লীলা! লীলা! তুমি বিয়ে করে ফেললে? এই তোমার কথার দাম? কোথায় সেই নৃপেন। বেরিয়ে আয় ব্যাটা। দেখে নেব তোকে!”
লীলা ভয়ে কাঁপছে, কী বলবে, বুঝতে পারছে না। সে তো জানত, উল্লাস মৃত। তার স্বামী নৃপেনের দিকে আগুনচোখে এগিয়ে যাচ্ছেন উল্লাসকর, “আমার লীলাকে তুমি বিয়ে করেছ? এত বড় স্পর্ধা?”
বিধ্বংসী উল্লাসের তেজ কে না জানে, ভয়ে নৃপেন ঝটিতি ঘরে ঢুকে খিল এঁটে দিচ্ছেন।
উল্লাসকর কিছুক্ষণ করুণ চোখে দেখছেন লীলার শাঁখাপলা, সীমন্তরঞ্জিত সিঁদুর, রাগ ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে দুঃখে। হাউহাউ করে কাঁদছেন। তারপর ধীরে ধীরে ঝোলা থেকে সব চিঠি বের করছেন। পলকে দেশলাই জ্বেলে জ্বালিয়ে দিচ্ছেন সেগুলো। বলছেন, “এগুলোকে তোমার সামনেই পুড়িয়ে যাব।”
লীলা ঝরঝর করে কাঁদছেন, শান্ত করার চেষ্টা করছেন, লীলার ভাই নিরঞ্জন বলছে খেয়ে যেতে, কে শোনে কার কথা! সব চিঠি পুড়িয়ে ছাই করে কথা না বাড়িয়ে তক্ষুনি উল্লাসকর বেরিয়ে পড়ছেন বাড়ি থেকে। তারপর বোম্বাই থেকে ট্রেন ধরে সোজা বাংলা। না। যে কলকাতায় ছড়িয়ে আছে ওঁর আর লীলার প্রেমের স্মৃতি, সেখানে থাকবেন না আর। সোজা চলে যাচ্ছেন নিজের দেশের বাড়ি, পূর্ববঙ্গের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কালীকচ্ছ গ্রামে। সেখানে একা একা থাকছেন। অলস জীবন। নৌকো করে ভেসে পড়ছেন নদীতে। কখনো দোকান খুলছেন। কখনো নিজের কারাজীবন নিয়ে লিখছেন বই।
এভাবে কেটে গেল আরো অনেক বছর। কলকাতায় এসে একদিন আবার দেখা নিরঞ্জনের সঙ্গে। এবার নিরঞ্জন সাংঘাতিক কথা বলল।
“লীলাদিদির স্বামী মারা গেছেন উল্লাসদা! লীলাদিদির দুটো পা-ই প্যারালাইজড হয়ে গেছে নার্ভের অসুখে। বোম্বাইতে চিকিৎসায় কিছু সুবিধে হয়নি, তাই ডাঃ বিধান রায় এখানে পিজিতে ভর্তি করে দিয়েছেন। দেখার কেউ নেই।”
“কী বলছিস! লীলা … কলকাতায়?”
তারপরের অংশ যে কোন চিরায়ত প্রেমকাহিনীকে হার মানাবে। পরেরদিনই উল্লাসকর চলে গেলেন পিজি হাসপাতালে। পাঁজাকোলা করে নিজের বুকে তুলে নিলেন ষাটোর্ধ্ব লীলাকে। লীলা স্তব্ধবাক। কয়েকদিন আসাযাওয়া করে সেবা করলেন। তারপর একদিন ঘোষণা করলেন, “আমি লীলাকে বিয়ে করব। করবই।”
বন্ধুবান্ধবের শত আপত্তি, বোঝানোতেও টলানো গেল না তাঁকে। উল্টে রেগে গেলেন। লীলা তো তাঁরই, তিনি ওকে দেখবেন না তো কে দেখবেন?
অবশেষে তেষট্টি বছর বয়সে তিনি বিয়ে করছেন তাঁর চেয়ে বছরখানেকের ছোট লীলাকে। বিয়ের রেজিস্ট্রেশনে লীলার ‘বিধবা’ পরিচয় দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠছেন। তাঁর লীলা তো এখনো তার চোখে কিশোরী, সে উল্লাসের বউ, অন্যের বিধবা হবে কেন? ওই নৃপেনের সঙ্গে বিয়েকে তিনি বিয়ে বলে মানেনই না। অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে তাঁকে শান্ত করা হচ্ছে।
ততদিনে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু ঘৃণাভরে তিনি প্রত্যাখ্যান করছেন ‘স্বাধীনতা সংগ্রামীর পেনশন ভাতা’। নিচ্ছেন না সরকারের থেকে কিছুমাত্র সুবিধা। না রাজনীতির কোন পদ, না কোন কিছু। তাঁর ক্ষমতার লোভ, অর্থের লোভ, খ্যাতির লোভ কিছুই নেই। সবার চোখের আড়ালে চলে গেছেন তিনি। বলেছেন,“স্বাধীন? এটা স্বাধীন দেশ? যে সরকার দেশভাগ করেছে, মরে গেলেও তাদের থেকে আমি এক পয়সা নেব না।”

বৃদ্ধ উল্লাসকর ও তাঁর পত্নী লীলা
বিয়ের পর পক্ষাঘাতগ্রস্থ স্ত্রীকে নিয়ে তিনি কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, সংসার পাতছেন আসামের শিলচরে। লীলার কোমরের নীচ থেকে সম্পূর্ণ অবশ, তাকে আদর করে খাওয়ানো, স্নান করানো, সমস্ত কিছু করতেন একা হাতে। প্রতিদিন বিকেলে কোলে করে স্ত্রীকে নিয়ে যেতেন ছাদে। দুজনে বসে সূর্যাস্ত দেখতেন চুপ করে। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁর ওভাবেই কেটেছিল। তাঁর মারা যাওয়ার কয়েকবছর আগে মারা গিয়েছিলেন লীলা।

বিলেতফেরত অধ্যাপকের মেধাবী পুত্র, সম্ভ্রান্তবংশীয় বিত্তবান পরিবারের সন্তান হয়েও স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র বিপ্লব তাঁর ও লীলার গোটা জীবনটাকেই ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। কিন্তু তাতে অনুশোচনা ছিল না বিন্দুমাত্র।
যতবার পড়ি, খুঁজে বের করি, ততবার বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে। তাঁর জন্য ছুটে গেছি শিলচরে। গেছি আরো অনেকের কাছে। উল্লাসকরকে নিয়ে থাকতে থাকতে আমি যেন অবসেসড হয়ে গিয়েছি! সেই ঘোর এই জীবনে আর কাটবে বলে মনে হয় না!
উল্লাস আনপ্রেডিক্টেবল। উল্লাস একজনই জন্মায়। তিনি যেমন সাহসী বিপ্লবী, তেমনই দামাল পাগল প্রেমিক।
তাঁর অবিশ্বাস্য জীবন নিয়েই আমার এই জীবনীমূলক উপন্যাস ‘উল্লাসকর – বোমা বিপ্লব প্রেমের মহাকাব্য’।
উপন্যাস কম লিখিনি, সামাজিক, থ্রিলার, ঐতিহাসিক, দার্শনিক। বিস্মৃত কোন মানুষের জীবনী কেন্দ্রিক উপন্যাসও লিখেছি প্রচুর। অষ্টাদশ শতকের অসামান্য স্মৃতিধর পণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন থেকে মধ্যযুগীয় ইনকিউজিশনের শিকার পর্তুগীজ গোয়ানিবাসী ডাক্তার গার্সিয়া দে ওরতা। মল্লরাজা বীরহাম্বীর, সেনাপতি কালাপাহাড় থেকে দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়।
কিন্তু এইভাবে কেউ আমার ব্যক্তিসত্ত্বায়, স্বপ্নে, জাগরণে কেউ আমায় অধিকৃত করতে পারেননি। উল্লাসকর পেরেছেন।
আর যবে থেকে আমার এই অবসেসান বেড়েছে, অস্বাভাবিক ঘটনাও বেড়েছে। বৃদ্ধ উল্লাসকর তাঁর শেষ জীবন অতিবাহিত করেছিলেন আসামের শিলচরে। লেখার প্রয়োজনে শিলচর আমায় যেতেই হত, কিন্তু হঠাৎ করেই ত্রিপুরার আগরতলায় বিতর্কসভায় যোগদান ও শিলচরের বরাক বঙ্গ সাহিত্য সভা থেকে আমন্ত্রণ এল। আকস্মিক এই আমন্ত্রণ যেমন কাকতালীয়, তেমনই আশ্চর্যের হল, নিঃসন্তান উল্লাসকর দত্তের বংশের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে আমি যোগাযোগ করলেও তাঁরা খুব একটা তথ্য দিতে পারেননি।
কিন্তু উল্লাসকর দত্তের ভ্রাতুষ্পৌত্র শ্রী কৌশিক দত্তগুপ্ত আমায় প্রচণ্ড সহযোগিতা করলেন। শুধু তাই নয়, আমার ওই হঠাৎ শিলচরের আমন্ত্রণ জেনে তিনি শিলচর বাসী কিছু অদ্ভুত মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন আমায়।
শিলচরে একটি সত্তর পঁচাত্তর বছর বয়সী ‘যুবক’ অথচ বৃদ্ধের দল আমায় নিয়ে সারা অঞ্চল ঘুরিয়ে দেখালেন। আমি দেখা করলাম এমন এমন মানুষের সঙ্গে, যারা বৃদ্ধ উল্লাসকরকে স্বচক্ষে দেখেছেন, তাঁর অলৌকিক পত্নীসেবা প্রত্যক্ষ করেছেন, এমনকি তাঁর কোলেপিঠে চড়েছেন, তাঁর ও তাঁর স্ত্রী লীলাদেবীর শেষকৃত্যে শ্মশানে কাঁধও দিয়েছেন। একে একে মানুষের সঙ্গে কথা বলি, আমার উত্তেজনার শিখরে পৌঁছতে থাকি। না। সেই অদ্ভুত সাক্ষাৎকারগুলো শুধু নিজের স্মৃতির জন্য রাখিনি, ভিডিও রেকর্ড করে নিয়ে এসেছি। সেই চমৎকৃত ডকুমেন্টারি সিরিজই হল ‘শিলচরে আমার উল্লাস’।
জুন মাসে আমি যখন গিয়েছিলাম, শিলচর তখন বন্যায় আক্রান্ত। সেই অবস্থাতেও গিয়ে যে অনাবিক আন্তরিকতা পেয়েছি, তার কোন তুলনা নেই। প্রবীর রায়চৌধুরী, চিত্রভানু ভৌমিক, সুগত পাল, পীযুষ চক্রবর্তী, নন্দদুলাল সাহা, গৌতম দত্ত … এঁরা প্রত্যেকে এই কয়েকমাসে হয়ে উঠেছেন আমার কাকু বা জ্যেঠু। অশক্ত শরীরে বন্যাকবলিত এলাকায় তাঁরা যে উৎসাহে শিলচর মহাশ্মশান থেকে বিভিন্ন মানুষের বাড়ি আমায় ঘুরিয়ে আমার গবেষণার কাজে সাহায্য করেছেন, সেই ঋণের কোন পরিশোধ হয় না। করতেও চাই না।

আর যার কথা না বললে অন্যায় হবে, তিনি শিলচরের এক ঋষিতুল্য ব্যক্তি। অবসরপ্রাপ্ত অশীতিপর অধ্যাপক ডঃ সুখময় ভট্টাচার্য। উল্লাসকর দত্তের ওপর তাঁর বই, তথ্য তো অমূল্যই, বিপত্নীক নিঃসন্তান মানুষটি এই বয়সেও যেভাবে বাড়িতে একার উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন মহাবিদ্যালয়, এখনো যেভাবে নিজেকে সারাক্ষণ ব্রতী রাখেন সমাজের কাজে, তাঁর আশীর্বাদে আমি ধন্য হয়েছি।
শিলচরে বহু বহু শিক্ষিত সংস্কৃতিবান বাঙালি বাস করেন। কিন্তু তাঁদের মন আমাদের অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালিদের প্রতি অভিমানে পরিপূর্ণ। তাঁরা বারবার আমায় দুঃখ করে বলেছেন, এর আগে বহু পশ্চিমবঙ্গীয় সাহিত্যিক এসেছেন, কথা দিয়েছেন আমাদের নিয়ে লিখবেন। কলকাতায় নেমেই সব ভুলে গেছেন। তুমি এইটুকু মেয়ে, সত্যি লিখবে তো?
আমি আবেগ এড়িয়ে সংক্ষেপে বলেছিলাম, “লিখব।”
তাঁদের বরাভয় আমায় সাহস জোগায়। উল্লাসকর দত্তকে নিয়ে উপন্যাস আগে লেখা হয়েছে, তবে ১০০০+ পৃষ্ঠার এত বিপুল পরিসরে কাজ সম্ভবত হয়নি। হতও না যদি না শিলচর ও আসামের বিভিন্ন অধ্যাপক আমায় এত সহযোগিতা করতেন।
আমার কাজে শুধু উল্লাসকর দত্ত নন, উঠে এসেছে শিলচরের ভাষা আন্দোলনও, যাতে প্রাণ হারিয়েছেন বহু মানুষ। আমরা বাংলাদেশের একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে মাতামাতি করি, অথচ নিজের দেশে বাংলা ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের ভুলে গিয়েছি। উল্লাসকরের শেষ জীবনের সঙ্গে আমি মিলিয়ে দিতে চেয়েছি শিলচরকে।
‘উল্লাসকর’ বোমা বিপ্লব প্রেমের মহাকাব্য আমার এই ট্রিলজির প্রথম ভাগ। তরুণ উল্লাসকর, বঙ্গভঙ্গ, বিপিন পাল থেকে শিলচর (১৯০৫-১৯০৯)। দ্বিতীয় ভাগ ‘কৃষ্ণসিন্ধুকী’ যা গতবছরেই প্রকাশিত (১৯০৯-১২)। তৃতীয় ভাগ আসবে সামনের বছরে, তাতে উল্লাসকরের কালীকচ্ছের জীবন। সবমিলিয়ে প্রায় ১১০০ পাতা। প্রকাশিত হবে ইংরেজিতেও।
এখানে আরেকটা মজার ব্যাপার বলি। ‘কৃষ্ণসিন্ধুকী’ ও ‘উল্লাসকর’এর কাহিনী স্বতন্ত্র। এর আগে বাংলা সাহিত্যে কোন উপন্যাস লেখার পর তার প্রিকোয়েল বা আগের খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। তবে, আমি দৃঢ় বিশ্বাস করি, আমি ‘উল্লাসকর’ লিখিনি। আমায় লেখানো হয়েছে।
এতে রয়েছে বহু দুষ্প্রাপ্য ছবি।
উল্লাসকর কি নন ফিকশন, নাকি রাজনৈতিক উপন্যাস? না প্রেমের উপন্যাস? কী জানি, বিচারের ভার আপনাদের হাতেই ছেড়ে দিলাম! তবে আমি হলফ করে বলতে পারি, ‘উল্লাসকর’ পড়ে তাঁর প্রেমে পড়বেন না, এমন একজনকেও পাওয়া যাবে না। এরপর আমি সারাজীবন আর যাই লিখিনা কেন, কোনদিনই তাঁর ছায়া থেকে বেরোতে পারবে না আমার প্রেমসত্ত্বা।
কয়েকটি পর্বে দেখতে পারেন আমার ডকুমেন্টারি সিরিজ ‘‘শিলচরে আমার উল্লাস’ – https://www.facebook.com/reel/1339933087498521https://www.facebook.com/reel/1339933087498521
